“তামিছাস” থেকে “টাকসু”(TACSU): ইতিহাসের ইতিহাস
—মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জসীম
ভূমিকা: জাতি গঠনের উপযোগী নেতৃত্ব তৈরীর সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬০ সনে “মজলিশে তা’মীরে মিল্লাত” নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় যার সভাপতি ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ:) এবং সেক্রেটারী ছিলেন অধ্যাপক গোলাম আযম (রহ:)। কয়েক বছর পর এই সংস্থার অধীনে “তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্ট” প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই ট্রাস্টের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ১৯৬৬ সনে ঢাকার মীরহাজীরবাগে কায়েম করা হয় “তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসা” যার শুভ উদ্বোধন করেন “সদর সাহেব হুজুর” খ্যাত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ:)। ছোট টিনের ঘরে অল্প সংখ্যক ছাত্র নিয়ে শুরু হওয়া মাদরাসাটি অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের শীর্ষস্থানীয় দ্বীনি বিদ্যাপীঠে উন্নীত হয়।
সময়ের পরিক্রমায় ক্রমবর্ধ্বমান চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রবলভাবে এর শাখা সম্প্রসারণের তাগিদ অনুভুত হতে থাকে। যার ফলে ১৯৯৭ সনে কায়েম করা হয় তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, টংগী ক্যাম্পাস।
তা’মীরুল মিল্লাত ছাত্র সংসদ(তামিছাস): ইসলামী জীবন দর্শন, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলিম সন্তানদেরকে আদর্শ নাগরিক রূপে গড়ে তোলা, বিশেষ করে নৈতিক অবক্ষয় থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষা করে চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন ও মূল্যবোধ তৈরীর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহায়তা প্রদান এবং ছাত্রদের প্রকৃত সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালন ও জাতীয় নেতৃত্ব তৈরীতে অবদান রাখার প্রত্যয় নিয়ে টংগী ক্যাম্পাসে ১৯৯৮ সনে “তা’মীরুল মিল্লাত ছাত্র সংসদ(তামিছাস)” নামে ছাত্র সংসদ কায়েম করা হয়। “তামিছাস” এর প্রথম ভি.পি ছিলেন জনাব হোসাইন আহমাদ (বর্তমানে সৌদি আরব প্রবাসী) এবং জি.এস ছিলেন এইচ.এম.আবদুল্লাহ আল-মামুন (বর্তমানে তানযীমুল উম্মাহ আলিম মাদরাসা, উত্তরা, ঢাকা এর প্রিন্সিপাল)।
“তামিছাস” এর নির্বাচন পদ্ধতি: তা’মীরুল মিল্লাত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দু’টি পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া স্বীকৃত। সময়, পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যে কোন একটি পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করে “তামিছাস” এক শিক্ষা বর্ষের জন্য গঠিত হয়ে থাকে।
১. নির্বাচন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া: এই পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় দু’টি দফায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। প্রথম দফায় দাখিল ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে কামিল শ্রেণী পর্যন্ত প্রত্যেক শ্রেণীর ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ভোটে ২জন করে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। ৫টি মূলনীতি মেনে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যথা:
- কোন প্রার্থী থাকতে পারবে না।
- কারো পক্ষে বা বিপক্ষে কোন প্রকার প্রচারনা ও গ্রুপিং করা যাবে না।
iii. কেহ নিজের ভোট নিজেকে দিতে পারবে না।
- প্রত্যেকেই প্রার্থী।
- প্রত্যেকেই ভোটার।
এভাবে মোট ১৬ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় যাদেরকে ক্লাশ ক্যাপটেইন বলা হয়। যে বেশী ভোট পায় তাকে ফার্স্ট ক্যাপটেইন আর যে ভোটে ২য় হয় তাকে সেকেন্ড ক্যাপটেইন বলা হয়।
২য় দফা নির্বাচনে ভোটার মাত্র ১৬ জন ক্লাশ ক্যাপটেইন। আর আলিম, ফাযিল ও কামিল এই তিন শ্রেণীর ৬ জন ক্যাপটেইন মূল সংসদের প্রার্থী। নিয়মানুযায়ী কামিল থেকে ভি.পি, ফাযিল থেকে জি.এস এবং আলিম থেকে এ.জি.এস নির্বাচনের বিধান থাকায় এ দফায় ক্লাশ ক্যাপটেইনগণ উক্ত তিন শ্রেণী থেকে নির্বাচিত ৬জন ক্যাপটেইনদের থেকে যে কোন তিন জনকে ৩টি ভোট প্রদান করতে পারে। কামিলের ২জন ক্যাপটেইন থেকে যে বেশী ভোট প্রাপ্ত হন সে ভি.পি নির্বাচিত হন। একই প্রক্রিয়ায় ফাযিল থেকে জি.এস এবং আলিম থেকে এ.জি.এস নির্বাচিত হন। এই দফার নির্বাচনও উক্ত পাঁচ মূলনীতি কঠোরভাবে মেনে অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ণাঙ্গ সংসদ গঠনকালে নির্বাচিত ক্যাপটেইনদেরকে সংসদের অন্যসব পদসমুহ পূরণ করার জন্য মনোনয়ন দেয়া হয়।
উক্ত দু’দফার নির্বাচনই মাদরাসা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত নির্বাচন কমিশন সম্পন্ন করে থাকেন।
এমন নিরপক্ষে ও ভারসাম্যপূর্ণ নির্বাচন পদ্ধতির উদাহরণ আমাদের দেশের অন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
২. মনোনয়ন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া: দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সার্বিক পারিপার্শিক পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং মাদরাসা প্রশাসন কোন অনিবার্য্য কারণে নির্বাচন দিতে না পারলে মনোনয়ন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় “তামিছাস” গঠিত হয়। এরকম অবস্থায় মাদরাসা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠান প্রধান ও বিদায়ী সংসদের সাথে পরামর্শ করে কেবলমাত্র ভি.পি ও জি.এস মনোনীত করেন। মনোনীতদ্বয় নিজেদের সাথে পরামর্শের ভিত্তিতে এ.জি.এস সহ প্রয়োজনসংখক পদে মনোনয়ন প্রদানের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ সংসদ গঠন করে থাকেন।
“তামিছাস” থেকে “টাকসু”(TACSU:)
১৯৯৮-৯৯ সন থেকে ২০১৮ সন পর্যন্ত তা’মীরুল মিল্লাত ছাত্র সংসদ সুনামের সাথে অত্যন্ত সফলভাবে গঠিত হয়ে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। কিন্ত ক্যাম্পাসে ছাত্রাধিক্য বৃদ্ধি এবং আবাসিক হল সমুহে অধিক ছাত্রের বসবাসের কারণে হল সংসদ গঠনের তাগিদ অনুভুত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ এর আগস্টে মনোনয়ন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় প্রথমবারের মত দু’টি আবাসিক হলে সংসদ গঠিত হয়। হল সংসদ দু’টি যথাক্রমে-
- হাজী শরীয়তুল্লাহ হল ছাত্র সংসদ,
- শহীদ তিতুমীর হল ছাত্র সংসদ।
এহেন পরিস্থিতিতে একটি কেন্দ্রীয় সংসদ গঠন আবশ্যক হয়ে পড়লে গঠিত হয় “TA’MIRUL MILLAT CENTRAL STUDENTS UNION(TACSU)।
ইতিহাসের ইতিহাস: মজলিসে তা’মীরুল মিল্লাত যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসা কায়েম করেছিলেন তা অর্জনের ক্ষেত্রে অত্র প্রতিষ্ঠান আজ সাফল্য ও খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছে, আলহামদুলিল্লাহ। একই সাথে দ্বীনি শিক্ষার সাথে সাধারণ শিক্ষার এমন এক অভূতপূর্ব সমন্বয় সাধনে সক্ষমতা অর্জন করেছে যার দৃষ্টান্ত সমকালীন ইতিহাসে বিরল। আর আগামী দিনের শিক্ষাদ্যোক্তা ও বিদ্যোৎসাহীদের জন্য যে মাইলফলক তৈরী করেছে তা শুধু ইতিহাসই নয়, ইতিহাসেরও ইতিহাস হয়ে থাকবে, ইনশা আল্লাহ।
তা’মীরুল মিল্লাতের এ সকল অর্জনের যারা অংশিদার টাকসু(TACSU) তার তালিকায় অন্যতম। টাকসুকে যারা বিভিন্ন সময় নেতৃত্ব দিয়ে এ পর্যন্ত এনেছেন তাদের অনেকেই এখন দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে দৃষ্টান্তমুলক ভূমিকা পালন করছেন তা যে কোন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের জন্য যেমনই আনন্দের তেমনই গর্বের।
জাতি গঠনের উপযোগী সৎ, যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব তৈরীর যে মিশন শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সনে তা আজ এক আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। আর এই মিশন বাস্তবায়নে টাকসুর ভূমিকা আগামী প্রজন্মের কাছে শুধু ইতিহাসই হবে না, বরং তা হবে ইতিহাসেরও ইতিহাস, ইনশা আল্লাহ।